Stock News 24

Fresh from BPL T20 Cricket

Friday, 28 January 2011

পুঁজিবাজার পতন : কিছু প্রশ্ন - very interesting writing

পুঁজিবাজার পতন : কিছু প্রশ্নখোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
আমি পুঁজিবাজারের ক্রেতা, বিক্রেতা বা ব্রোকার কোনোটাই নই। বলা যায় সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি একজন দর্শক মাত্র। সেই সঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতা-দালালদের কথাবার্তা কানে আসে। মেলাতে চেষ্টা করি। এই হলো আমার লেখার উপাদান। প্রশ্ন হতে পারে, শোনা কথা লিখছি কেন? জবাবে মনে পড়ছে বাংলা প্রবাদ 'যা রটে, তার কিছু তো বটে।' আর দর্শক হিসেবে যা মনে হয়েছে, তা প্রকাশ করা নৈতিক দায়িত্ব। সত্যতা না থাকলে হারিয়ে যাবে। সত্য হলে সচেতনতা বাড়বে।
২০১০ সালে দুইবার বড় রকমের জোয়ার এসেছিল শেয়ারবাজারে। শেষটা ছিল সেপ্টেম্বরে। এর আগে থেকেই সাংবাদিকরা সাবধানধ্বনি উচ্চারণ করেছিলেন। মনে পড়ে, একজন অভিজ্ঞ অর্থনৈতিক সাংবাদিক একদিন দুপুরে আমার সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা উৎকণ্ঠা নিয়ে আলাপ করছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পুঁজিবাজার উল্লম্ফনটি ভয়ংকর অস্বাভাবিক। পতন হলে আরেকটি ছিয়ানব্বই হবে। আমি অনুরোধ করেছিলাম পতনের দুঃস্বপ্নটি না দেখিয়ে সাংবাদিকদের উচিত শোধরানোর উপায় বাতলানো এবং আস্থা বিনষ্ট না করা। সাংবাদিক কথা রেখেছিলেন। আমিও কথা রেখেছিলাম। উৎকণ্ঠাটি বারবার টক-শোসহ বিভিন্ন আলোচনায় প্রকাশ করেছি। কিন্তু কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ হয়নি, যদিও স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে লাখ লাখ মানুষের।
মার্কেটিং তত্ত্বেও 'বাজার' বলতে যা বোঝায়, পুঁজিবাজার তেমন নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। এটি একটি ফটকা কারবার। 'বাজার' ব্যাখ্যা করা যায়। ফটকা কারবার ব্যাখ্যা করা যায় না। কেন ১০০ টাকার শেয়ার ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যদিও কম্পানিটি অচল। এর ব্যাখ্যা কি বাজার অর্থনীতিতে মিলবে? সে জন্যই এটা বাজার নয়। জুয়া খেলা। তবে সংগঠিত বিদেশি পুঁজিবাজার সম্পর্কে এ কথা প্রযোজ্য নয়। সেখানেও জোয়ার-ভাটা আছে, যা মোটামুটি ব্যাখ্যাযোগ্য।
ঢাকা শেয়ারবাজারে সেপ্টেম্বর উল্লম্ফনের পর টক-শোতে বলেছিলাম (যা পরেও বলেছি) যে একটা দুষ্টু ছেলে বিরাট আমগাছটার কচি আগডালে উঠে গেলে,হয় সে ডাল ভেঙে ধপাস করে মাটিতে পড়ে হাত-পা ভেঙে ফেলবে, নচেৎ ধীরে ধীরে সাবধানে নেমে আসবে। নামতে তাকে হবেই। টক-শোতে অনুরোধ করেছিলাম, অন্ততপক্ষে সাবধানতার সঙ্গে ধীরে ধীরে নামতে সবাই যেন সহযোগিতা করেন। নামার কোনো বিকল্প নেই। কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে মন্তব্য করেছিলেন, 'বুলিশ মার্কেটে' এমনটা হয়েই থাকে, চিন্তার কিছু নেই। ধারণাটা যে কতটা 'ফুলিশ' ছিল, অনেক দণ্ড দিয়ে তা বুঝতে হলো। একটি সম্ভাবনাময় শেয়ারবাজার গড়ে উঠেছিল। শত শত শিক্ষিত বেকার স্বনিয়োজিত হয়েছিলেন। কর্মসংস্থানের একটি নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হচ্ছিল। জুয়াড়ি সিন্ডিকেটের চক্রান্তে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতায় (সহায়তায়?) লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কর্মচ্যুত হলো অনেক যুবক। ভাবতে অবাক লাগে, এত সবের পর একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী (যিনি সজ্জন ব্যক্তিও বটে) সাংবাদিকদের কাছে বললেন, শেয়ারবাজার পতনে সরকারের কিছু আসে যায় না! 'ওয়েট অ্যান্ড সি'_এ ধরনের মন্তব্য করাই কি তার পক্ষে শোভন হতো না?
ঘুরেফিরে যে কথাটি বারবার কানে আসছে, তা হলো সেপ্টেম্বর ২০০৯ থেকে গত চার মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা, নাকি আনহোলি অ্যালায়েন্সের একটি সিন্ডিকেট মেরে দিয়েছে। সিন্ডিকেটের মূল সদস্যসংখ্যা নাকি দেড় থেকে দুই ডজনের বেশি নয়। তবে বিও অ্যাকাউন্ট গণনা করলে, সহযোগী ও বেনামিসহ সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে। মূল খেলোয়াড়রা নাকি বেশির ভাগ বিএনপি ঘরানার, যদিও পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তিরা। সংসদে দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও পুঁজিবাজারে হরিহর আত্মা। বুঝহ সেজন, যেজন জানো হে সন্ধান।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন আছে। বিধিবিধান আছে। আছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, সিকিউরিটি অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন। শোনা যায়, নিয়ন্ত্রক নাকি নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে! তাও নাকি সিন্ডিকেটের হাতে! সবাই তো সরকারকে দোষারোপ করছে। সরকার কোনো ব্যক্তি নয়। সরকার চলে বিভিন্ন বিধিবদ্ধ সংস্থার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ সংস্থা দায় এড়াবে কিভাবে? সরকার কি অ্যাকাউন্টিবিলিটি নিশ্চিত করবে? কমিশন কি পুনর্গঠিত হবে?
বাতাসে অনেক কথা ভেসে বেড়াচ্ছে। কিছু কিছু কথা তুলে ধরছি, কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করছি। দেখা যাক, সরকার ক্রিয়াশীল না ভাবলেশহীন! নাকি প্রতিক্রিয়াশীল!
একটি মুখরোচক রটনা হলো এই যে সিন্ডিকেটের বেশির ভাগ সদস্য বিএনপিপন্থী। আওয়ামীদের নেতৃত্বে তারা কাণ্ডটি পরিকল্পিতভাবে ঘটিয়েছে। পুঁজি নিয়ন্ত্রক সংস্থার সহযোগিতায়। উদ্দেশ্য দুটি। হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া গেল। একই সঙ্গে মহাজোট সরকারকে একহাত দেখিয়ে দেওয়া হলো। এক ঢিলে দুই পাখি শিকার! রটনাটি কিন্তু পরীক্ষাযোগ্য। তদন্ত করে নামে-বেনামে কারা অধিক উপার্জন করেছে, তার তালিকা বের করা সম্ভব। তাদের রাজনৈতিক রংও নির্ণয় করা সহজ। সিন্ডিকেটের আওয়ামী সদস্যদের চিহ্নিত করাও কঠিন নয়। সরকারের কোনো কোনো ক্ষমতাশালীর মাধ্যমে তারা বাধাহীনভাবে লুটতরাজ ঘটিয়ে চলেছিল, তাও উচ্চপর্যায় থেকে শনাক্ত করা যায়। কারণ কিছু কিছু সিদ্ধান্ত ওপর থেকে হয়ে থাকে। ওই সব সিদ্ধান্তের তদবিরে কারা ছিলেন, সেটি যাচাই করলেই আলামত পাওয়া যাবে। তবে এর জন্য প্রয়োজন কঠিন সদিচ্ছা এবং আত্মসংশোধনের অঙ্গীকার।
দু-একটি বাজারের রটনা তুলে ধরা যাক। কোনো ইঙ্গিত মেলে কি না দেখার জন্য। প্রথমেই আসা যাক সিকিউরিটি অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের একজন বহুল আলোচিত মেম্বারের বিষয় নিয়ে। শোনা যায়, তাঁকে নাকি এখন 'নিষ্ক্রিয়' করা হয়েছে। আবার এও শোনা যায়, তিনি নাকি পদত্যাগ করেছেন। এই সদস্যের বিষয়ে সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে, মেসেজ পেঁৗছে যেত এবং অনেক অঘটন হয়তো ঘটত না। এই সদস্যকে 'মেম্বার' হিসেবে প্রথম টার্ম শেষ করার পর দ্বিতীয় টার্মের জন্য পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল কয়েক মাস আগে। তখন শুনেছিলাম, ওই সদস্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের চুক্তিপত্র সই না করেই তিন বছর চাকরি করেছেন, যা চাকরিবিধি অনুযায়ী একটি অনিয়ম। পুনর্নিয়োগের আগেই ওই সদস্য সম্পর্কে সরকারের উচ্চপর্যায়ে সতর্কবাণী পেঁৗছানো হয়েছিল মর্মে আমি নিশ্চিত হয়েছি। তা সত্ত্বেও (এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অসম্মতি সত্ত্বেও) সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাঁর পুনর্নিয়োগ মঞ্জুর হয়ে এসেছিল। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ, কোন কোন ক্ষমতাশালী সরকারি ও বেসরকারি ব্যক্তি ওই সদস্যের পুনর্নিয়োগে অবদান রেখেছিলেন, তা আপনার ও সরকারের স্বার্থে তদন্ত করে দেখুন। কালো বিড়াল চিহ্নিত করার জন্য এটি একটি ইঙ্গিত।
বাতাসে আরো একটি কথা ভাসছে। রটনাটি আদৌ সত্য হলে তথ্যটি ভয়ংকর। শোনা যায়, সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা নাকি উচ্চপর্যায়ে সিকিউরিটি অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের কোনো এক নির্বাহীর বিষয়ে সর্বৈব মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে ঘোলা জলে মৎস্য শিকার করতে চেয়েছিল। পর্যালোচনায় ধরা খেয়ে যাওয়ায় সংস্থাটি বোকা বনে গেছে। সত্যি এমন কিছু ঘটে থাকলে, বিষয়টি ওখানেই থেমে যাওয়া উচিত। কার স্বার্থে, কিসের বিনিময়ে এবং কোন কর্মকর্তা মিথ্যা রিপোর্ট প্রদানের সাহস পেল, সেটি খতিয়ে দেখা উচিত। তা না হলে, মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক তথ্য সরবরাহ অক্ষুণ্ন থাকবে, যা রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বের জন্য ক্ষতিকর।
আরো একটি কথা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বেশ কয়েক মাস যাবৎ। আগে ঘুষের কথা শোনা যেত। কিন্তু তা নয়। এখন শোনা যাচ্ছে, সিন্ডিকেট নাকি গুরুত্বপূর্ণ অফিসের ছোট, মাঝারি, বড় চাকুরেদের শেয়ার (হালাল ঘুষ?) খাইয়েছে। সিন্ডিকেটই দাম ওঠা-নামা করায়। সে প্রক্রিয়ায় এসব 'গরিবদের' দুই পয়সা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা। আইপিওতে লাভ ভালো। সেগুলো ভাগযোগ করে দেওয়া এসব সহায়কদের মাঝে। ইন্টেলিজেন্সের ইনফরমাররাও বাদ যাবেন কেন? অবৈধ কিছু তো নয়। শেয়ার ব্যবসা তো একেবারেই হালাল। অনায়াস লাভে ইনফর্মারের ইনফরমেশন পাল্টে গেলে অঘটন ঘটে যেতে পারে। সংবেদনশীল পদে নিয়োজিতদের (ছোট-বড় সবাই) শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা উচিত কি না, তা নির্ধারণ করার ভার রাষ্ট্রের। তবে আমার পেশা জীবনের একটি তথ্য পেশ করতে পারি। পাকিস্তান আমলে করাচিতে তৎকালীন বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক হাবিব ব্যাংকের চাকরিতে যোগদান করেছিলাম প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে। অনেক ফরম, নিয়মাবলি ও অঙ্গীকারনামায় দস্তখত করতে হয়েছিল চাকরিতে যোগদানকালে। তার মধ্যে একটি অঙ্গীকারনামায় ছিল শেয়ারবাজার সম্পর্কে। অঙ্গীকার করতে হয়েছিল, 'ব্যাংকে চাকরিরত অবস্থায় আমি পুঁজিবাজারে বা অন্য কোনোভাবে কোনো কম্পানির শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করব না, করতে সাহায্য করব না, এমনকি তেজি-মন্দা বিবেচনায় নামে-বেনামে বা কোনোভাবে অর্থ বিনিয়োগ করব না।' ব্যাংকারদের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ে তখনো কোনো আইনি বাধা ছিল না। কিন্তু নৈতিকতাবিরোধী বিবেচিত বিধায় অঙ্গীকারনামা নেওয়া হতো। সেই থেকে আমি কোনো দিন শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করিনি দীর্ঘ ব্যাংকার জীবনে। শেয়ার নামীয় জুয়া খেলার ব্যাপারে সরকার কি সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করবে? বিধিনিষেধ অর্পণ করবে? বাংলাদেশ ব্যাংকের দু-চারজন কর্মকর্তা পুঁজিবাজারে খেলা খেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজে ও সুনামে কেমন কালিমা লেপন করেছিলেন, সরকার ইচ্ছা করলে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দুটি শব্দ অনেকবার উচ্চারণ করেছেন। প্রকাশ্যে এবং নিভৃতে। শব্দ দুটি ছিল 'আত্মসমালোচনা' ও 'আত্মসংশোধন'। সে উদ্দেশ্যেই এ লেখাটি। বলা হতে পারে, এতই যদি শুভাকাঙ্ক্ষী, তাহলে প্রকাশ্যে না লিখে গোপনে বললেই হতো। হলে ভালো হতো। হয়নি। গোপনে এবং নিম্নকণ্ঠে অনেক বলেছি। কেউ কর্ণপাত করেনি। তাই 'ঘা দিয়ে জাগাতে' চাচ্ছি। মাত্র বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় আংশিক কার্যকর হয়েছে। দুরাচার, যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতাবিরোধীদের বিচার শুরুই হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের অনেক অর্জন নষ্ট হয়ে গেছে। উদ্ধারের কাজ শুরু করেছে এ সরকার। অনেক কাজ বাকি। তাই মুক্তিযুদ্ধের মহাজোটকে আফিম খাইয়ে ঘুমপাড়ানি গান যারা শোনায় তাদের শনাক্ত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে ঘা দিয়ে জাগিয়ে তোলা সচেতন নাগরিকদের দায়িত্ব।
২৩ জানুয়ারি ২০১১

লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বর্তমানে কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান
News Source: KalerKonto

No comments:

Latest from BPL ground